ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫ , ৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
সংবাদ শিরোনাম
ধুঁকছে শিল্প খাত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে ৩১ দফার কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিএনপি নেতা মশিউর রহমান গনসংযোগ ও লিফলেট বিতরন করেছেন তালতলীতে আমতলীতে সড়ক দূর্ঘটনায় বাবা মেয়েসহ নিহত তিন এবার বর্ণবাদের অভিযোগ আনলেন রুডিগার সিটির সামনে দাঁড়াতে পারলোনা আল আইন ১০ জন নিয়েই দাপুটে জয় পেলো রিয়াল অবশেষে ক্রিকেটারদের পাওনা অর্থ দিতে রাজি হলো ওমান টেস্টের নেতৃত্ব থেকেও সরে যাওয়ার গুঞ্জন শান্তর যা কারণে জাতীয় দলে জায়গা পেলেন না সোহান ওয়ানডে দলে জায়গা না পেয়ে সোহানের আক্ষেপ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টাইগারদের ওয়ানডে দল ঘোষণা নগর ভবন খুলে দেবেন ইশরাকের সমর্থকরা এভাবে চলতে থাকলে কিয়ামত পর্যন্ত শতভাগ ঐকমত্য হবে না : নুর কিছু বিষয় ‘অমীমাংসিত’ সব দলকে ছাড় দেয়ার আহ্বান আলী রিয়াজের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে একমত জামায়াত-এনসিপি সায় নেই বিএনপির সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ল ১০ হাজার কোটি টাকা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন যুক্তরাষ্ট্র কি ইরাকের ভুল এবার ইরানে করছে-প্রশ্ন চীনের আমরা ইসরায়েলের জন্য সব হুমকি গুঁড়িয়ে দিয়েছি-ট্রাম্প
* প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতের মারাত্মক তারল্য সংকট * লাগামহীন খেলাপি ঋণ ও বিনিয়োগ স্থবিরতায় অস্থিরতা * রিজার্ভে চাপ ও জ্বালানি সংকটে দুর্বল হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক ভিত্তি

ধুঁকছে শিল্প খাত

  • আপলোড সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ১২:০২:০৯ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ১২:০২:০৯ পূর্বাহ্ন
ধুঁকছে শিল্প খাত
বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে প্রতিটি খাতে দেখা দিয়েছে সংকটের ছায়া। ব্যাংক খাতের মারাত্মক তারল্য সংকট, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, বিনিয়োগ স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভে চাপ এবং জ্বালানি সংকট মিলিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফের কঠোর শর্ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অভ্যন্তরীণ নীতিগত দুর্বলতা। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো দেশের বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রফতানি কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়ে এক কঠিন সময় পার করছে গার্মেন্টস খাত। সংকট কাটাতে সরকারি সহায়তার ঘাটতির পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা ও উদ্বেগ।
অপরদিকে, ঈদের আগে ব্যাংক বন্ধ থাকাকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তৈরি পোশাক মালিকরা এখন ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, বিগত সরকারের শেষ দুই বছরে আমাদের খাত চরম সংকটে পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সময় ইডিএফ (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) সুবিধা বাতিল করা হয়, ইনসেনটিভ বন্ধ হয়ে যায়, পাশাপাশি সুদের হারও বেড়ে যায়। একই সময় ভয়াবহ রূপ নেয় গ্যাস সংকট।
তিনি জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পুরনো সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এই সরকার চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিষয়ে আগের সরকার যে ৬ মাসের সুবিধা দিয়েছিল, আইএমএফের পরামর্শে সেটিও বাতিল করা হয়েছে।
বিকেএমইএ সভাপতি আরও বলেন, বর্তমানে জ্বালানি সংকট আরও প্রকট হয়েছে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাক রফতানির ওপর ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে ক্রেতারা আমাদের পোশাকের দাম গড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক উদ্যোক্তার মূলধন এখন হুমকির মুখে। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের বন্দর ব্যবহারে আগের মতো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত থেকে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তকেও তিনি ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ রফতানি খাতের ওপর।
তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। তিনি বলেন, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা এখন এক ধরনের টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যখন শ্রমিক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়াই, তখনও খরচ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এখন সে অবস্থাও নেই। তিনি জানান, বিগত সরকারের সময়ে শ্রমিকদের বেতন গড়ে ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। অথচ একই সময়ে পোশাক খাতের জন্য ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা বা ইনসেনটিভ বাতিল করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবে তা ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়নি। রুবেল বলেন, আসলে তখনও আমরা লোকসানে ছিলাম, এখনও আছি। তবে এটা বোঝা উচিত গার্মেন্টস খাতের লোকসান মানেই তিন হাজার কারখানা লোকসানে, এমন নয়। এই শিল্প খাতটি সামগ্রিকভাবে লোকসানে রয়েছে। বিশেষ করে ছোট এবং মাঝারি কারখানাগুলো টিকে থাকার জন্য লড়ছে। এর মধ্যে কিছু বড় কারখানা এখনও লাভের মধ্যে রয়েছে, তবে সংখ্যায় তারা কম। তিনি আরও বলেন, জ্বালানি সংকট, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াসহ নানা প্রতিকূলতায় তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে এক জটিল সময় অতিক্রম করছে।
বিজিএমইএ’র সদ্য নির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান অবশ্য তুলনামূলক আশাবাদী। তিনি বলেন, জুলাই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, এখন তা অনেকটাই কেটে গেছে। সরকারের শুরুর সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ ছিল, সেটিও এখন উন্নত হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম ও লুটপাটও কমেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, গার্মেন্ট খাত এখনও কাঙ্ক্ষিত ব্যাংকিং সাপোর্ট পাচ্ছে না। অর্ডার আগের তুলনায় কম, পোশাকের দামও ৫ শতাংশ কমে গেছে। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়েছে, ডলার সংকট রয়েছে। তবু রফতানি আয় বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা কাজ করছে, যার প্রভাব পড়ছে তাদের মনোসংযোগ ও সিদ্ধান্তে। তিনি বলেন, যখন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থাকে, তখন কোনও কিছুতেই মন বসে না। এখন ব্যবসায়ীদের মাঝেও সেই অবস্থা বিরাজ করছে। নানা অনিশ্চয়তা ও চাপের কারণে তারা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। হেলাল উদ্দিন মনে করেন, যারা নিয়মিত ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছেন, তাদের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে আরও উৎসাহ ও সহযোগিতা দেওয়া উচিত। সরকারের ব্যবসাবান্ধব ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখন জরুরি, বলেন তিনি। হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, এখন এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব চলছে। এর মধ্যে ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যাংক টানা ১০ দিন বন্ধ থাকায় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এটি ব্যবসার গতি কমিয়ে দেয়, পেমেন্ট চেইন ভেঙে দেয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, পৃথিবীর কোনও দেশেই একটানা ১০ দিন ব্যাংক বন্ধ রাখার নজির নেই।
রিজার্ভ রক্ষা এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২০২৩ সালে আইএমএফ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় বাংলাদেশ। তবে এর বিপরীতে বিদ্যুৎ-জ্বালানি ভর্তুকি প্রত্যাহার, মুদ্রা বিনিময় হার বাজারনির্ভরকরণ, ব্যাংক সংস্কারসহ বেশ কিছু কঠিন শর্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর ফলে পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের ঘাটতিতে পোশাক, সিরামিক, ওষুধ এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে রফতানি আদেশ হারানোর ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। ২০২৫ সালের মে মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৫ শতাংশে। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের লাগাতার দাম বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা— যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গত তিন মাসে এই ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখন অনাদায়ী ঋণের হার ২৪.১৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। খেলাপি ঋণ লুকানোর প্রবণতা কমে আসায় এখন প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিসুদের হার ১০ শতাংশে উন্নীত করেছে, যা দেশের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চহার। এতে ব্যাংকের ঋণ পেতে উদ্যোক্তাদের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হচ্ছে। এর ফলে বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমার আগে নীতিসুদের হার কমবে না। গত এপ্রিল মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৫০ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৪০ শতাংশ কম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঋণ প্রবৃদ্ধি কমার মানে বিনিয়োগ কমছে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, দারিদ্র্য বিমোচন ব্যাহত হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ৯১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭ কোটি ডলার কম। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলার সংকট এবং অবকাঠামো দুর্বলতা এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

কমেন্ট বক্স